মহেশখালীর মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ২০২৩ সালে উৎপাদনে যাবে। এই প্রকল্পকে দেশের বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সেক্টরের হাব হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। একই সাথে নির্মাণ করা হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ডিপ সী পোর্ট। নির্মাণ করা হবে এলএনজি ল্যান্ড টার্মিনাল। প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার এসব প্রকল্পের মাধ্যমে পুরো মহেশখালীকে সিঙ্গাপুরের আদলে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ি ১২শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ ইতোমধ্যে ১৮ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৫ জানুয়ারি প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন। প্রধানমন্ত্রী মহেশখালীতে একটি জনসভায়ও ভাষণ দেবেন।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করতে এসে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এসব কথা জানান। এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত কয়েক হাজার মানুষকে পুনর্বাসন করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্থানীয়দের জন্য বাড়িঘর হচ্ছে। এই যে ধু–ধু বালি, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তা উন্নত বিশ্বের আদলে গড়ে উঠবে।
জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে কুহেলিয়া নদীর তীরে ৭ হাজার ৬শ ৫৬ একর জমিতে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল পদ্ধতির সমন্বয়ে প্রতিটি ৬০০ মেগাওয়াট করে দুটি কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। ১২শ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে ৮/১০ হাজার টন কয়লা ব্যবহৃত হবে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত এই কয়লা বড় বড় মাদার ভ্যাসেলের মাধ্যমে পরিবহন করা হবে। এই মাদার ভ্যাসেল বার্থিং করানো হবে বন্দরে। এখানে একটি আর্টিফিশিয়াল ডিপ সী পোর্ট নির্মাণ করা হবে। দেশের অন্যান্য কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় কয়লাও এই ডিপ সী পোর্টের মাধ্যমে আমদানি করা হবে। এখান থেকেই অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা অভ্যন্তরীণ নৌ রুটে পরিবাহিত হবে। প্রকল্পের অংশ হিসেবে একটি ল্যান্ড এলএনজি টার্মিনালও নির্মাণ করা হবে। সবকিছু মিলে মহেশখালী হবে দেশের এনার্জি হাব। তিনি জানান,এই প্রকল্পের জন্য জাপানের পাঁচটি কোম্পানি ইকুইপমেন্ট সরবরাহসহ নির্মাণ কাজে সংশ্লিষ্ট রয়েছে। এগুলো হচ্ছে সুমিতোমো করপোরেশন, আইএইচআই, তোশিবা এবং পেন্ট–ওসেন কনস্ট্রাকশন। কোম্পানিগুলো বয়লার, পাওয়ার জেনারেটরসহ আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করবে; যা জাপানে প্রস্ততকৃত। পেন্টা–ওসেন কনস্ট্রাকশন নামের কোম্পানি আর্টিফিশিয়াল ডিপ সী পোর্ট নির্মাণ করবে। বিশাল এই প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশের অন্যতম সহযোগী সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। দশমিক শূন্য শূন্য এক শতাংশ সুদে জাইকা এই অর্থ প্রদান করছে। বিশ্বে এটি জাইকার সবচেয়ে বড় প্রকল্প।
মাতারবাড়ির উপকূলীয় বিস্তৃত এলাকার লবণ মাঠের সাড়ে ৭ হাজার একরের চেয়ে বেশি জায়গা নিয়ে গড়ে উঠছে প্রকল্প। প্রকল্পের ১৮ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। পুরো এলাকা তারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। সাগর থেকে বালি এনে পুরো এলাকা ভরাট করা হচ্ছে। নির্মাণ করা হচ্ছে রাস্তাঘাট, বাঁধসহ বিভিন্ন অবকাঠামো। জাপানি ও দেশীয় মিলে কয়েকশ মানুষ কাজ করছে। অসংখ্য ডাম্প ট্রাক, স্কেভেটরসহ বিভিন্ন ইকুইপমেন্টের সাহায্যে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। বাঁধ নির্মাণের ফলে শুধু সাড়ে ৭ হাজার একর নয়, আশপাশের কয়েক হাজার একর জমির লবণ চাষ বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে গেছে শত শত মানুষ। প্রকল্পে কিছু কিছু লোকের চাকরি হলেও অধিকাংশ লোকই বেকার হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা গতকাল জানান, প্রকল্প হচ্ছে ভালো কথা, কিন্তু আমরা শেষ হয়ে গেছি। আমাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করলে পরিবার–পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদানে জেলা প্রশাসনের এলএ শাখায় নানাভাবে হয়রানি হওয়ার কথাও জানান তারা। অনেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে এলএ শাখার নির্ধারিত হারের ঘুষের যোগান দিয়ে চেক পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। তারা বলেন, কাগজে–পত্রে সমস্যা দেখিয়ে অনেককেই ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়নি। আবার উপকূলে সরকারি খাস জায়গায় বসবাস করত এমন বহু মানুষও গৃহহীন হয়েছে। তারা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে। কাউকে গৃহহীন করা হবে না। বাড়িঘর হচ্ছে। স্কুল হচ্ছে। উপাসনালয় হচ্ছে। তিনি বলেন, স্থানীয় লোকদের বিভিন্ন কাজে অভিজ্ঞ করার জন্য একটি ট্রেনিং স্কুল করা হচ্ছে। এরা তো আর লবণ চাষ করবে না। অন্য কিছু করবে। জব ট্রান্সফারের ব্যবস্থা আমরা করে দিচ্ছি। তিনি বলেন, এখানে ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের কাজের ক্ষেত্র তৈরি হবে। কেউ বেকার থাকবে না।
পাঠকের মতামত